• ইতিহাসের পাঠশালায়-১০

দশম অধ্যায় • চার্চ ও পোপতন্ত্র

খ্রিস্টধর্মের সমস্ত ইতিহাসের মূলে পাওয়া যায় বিভিন্ন চার্চ ও পোপতন্ত্রের ভূমিকা। তাই চার্চ ও পোপতন্ত্রের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক যুগে চার্চের অস্তিত্ব ছিলো না। প্রথমদিকে খ্রিস্টধর্মীয় কর্মকান্ড ও আরাধনা চলত সমাধি মন্দির বা মঠসমূহে। ইংরেজিতে এগুলোকে বলা হয় সড়হধংঃবৎু. খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে মনাস্টেরির ভূমিকা অনেক ব্যাপক। মনাস্টেরির ভূমিকা ছিলো চার্চ থেকে স্বতন্ত্র। জাগতিক জীবনবিচ্ছিন্ন এক সন্নাস জীবনের চর্চা হতো মনাস্টেরির অভ্যন্তরে। খ্রিস্টধর্মের আধ্যাত্মবাদের কেন্দ্র হলো এসব মনাস্টেরি।

সাধারণত কোনো বড় সেইন্ট এর সমাধিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত একেকটি মনাস্টেরি। সংসার বা সামাজিক জীবন নয়, সন্নাস জীবনের চর্চাই ছিলো মনাস্টেরির মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে চার্চের ভূমিকা ছিলো ভিন্ন। চার্চের ভূমিকা ছিলো সমাজ জীবনকে ঘিরেই। সমাজ জীবনই ছিলো চার্চের কার্যক্রমের ভিত্তি। খ্রিস্টধর্মের শুরুর দিকে যাজক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো না। যাজকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে। ক্রমে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটলে ধর্মীয় কার্যক্রম অভিন্নভাবে পরিচালনার জন্য একটি সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।

139

চিত্র: শিল্পীর তুলিতে মধ্যযুগের একটি চার্চ

এ প্রয়োজন থেকেই ধীরে ধীরে চার্চ সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। প্রাথমিক চার্চ সংগঠনই খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের সংকলন সম্পন্ন করে। মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময়ে চার্চ সংগঠন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সমান্তরাল শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। চার্চের এই প্রভাব অর্জনে অবশ্য বেশ কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছে। প্রাথমিক যুগে চার্চের অধিকর্তাকে বলা হতো প্রেসবাইটার (presbyter) অথবা বিশপ (bishop)। দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যেই চার্চ সংগঠনের একটি কাঠামো গড়ে উঠেছিল। যাজকদের মধ্যেও বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি হয়।

গ্রামের ছোট চার্চগুলো পরিচালিত হতো শহরের বড় চার্চের অধীনে। গ্রাম্য চার্চের পাদ্রীগণ কাজ করতেন শহরের বড় চার্চের পাদ্রীর অধীনে। বিশপের উপাধিধারী একজন পাদ্রী এই চার্চ পরিচালনা করতেন। বিশপের আওতাধীন এলাকাকে বলা হতো ডায়োসিস (diocese)। বিশপ তাঁর ডায়োসিসের সবগুলো চার্চের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং ধর্মগুরুর দায়িত্ব পালন করতেন। কয়েকটি ডায়োসিসের সমন্বয়ে তৈরি হতো প্রদেশ। প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহরের বিশপ হতেন প্রদেশের অধিকর্তা। তাঁর উপাধি হতো আর্চবিশপ। প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে একটি বিশাল প্রশাসনিক অঞ্চল গঠন করা হতো। এর নাম ছিলো প্যাট্রিয়ার্কেট (patriarchate).

একেকটি বিশাল শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত একেকটি প্যাট্রির্য়াকেট। এসব বিশাল শহরের বিশপরা হতেন সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান এবং প্যাট্রিয়ার্কেটের প্রধান। তাদের বলা হতো ছিলো প্যাট্রিয়ার্ক (patriarch)। চার্চ সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের যাজকদের পদের নামকরণের সাথে রোমান প্রশাসনিক শব্দের মিল দেখা যায়। এর কারণ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের যুগে রোমান প্রশাসনের দায়িত্ব চলে গিয়েছিল যাজকশ্রেণি ও খ্রিস্টধর্মের হাতে। প্যাট্রিয়ার্কেট, বিশপ প্রভৃতি শব্দ ছিলো রোমান প্রশাসনিক শব্দ। রোমের পৌরসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসের নাম ছিলো বিশপ।

কনস্টানটাইনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর চার্চ সংগঠন অনেক বড় সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তখনও চার্চ সংগঠন বা  খ্রিস্টধর্মজগতের ওপর কোনো একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আসলে কখনোই সমস্ত দেশের চার্চ ও খ্রিস্টধর্মের ওপর কোনো চূড়ান্ত একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। খ্রিস্টধর্মজগতের ওপর কয়েকটি প্যাট্রিয়ার্কেটের ছিলো আলাদা নিয়ন্ত্রণ। এসব প্যাট্রিয়ার্কেট হলো আলেকজান্ত্রিয়া, জেরুজালেম, এন্টিয়ক, কনস্টানটিনোপল এবং রোম। কালক্রমে এই পাঁচটি প্যাট্রিয়ার্কের মধ্যে রোম শীর্ষস্থানীয় ভূমিকায় চলে আসে এবং রোমের প্যাট্রিয়ার্ক খ্রিস্টধর্মজগতের সবচেয়ে বড় অংশের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন।

140.png

চিত্র : শিল্পীর তুলিতে সেইন্ট পিটার

রোমের প্যাট্রিয়ার্কের উপাধী হয় পোপ (pope); রোমান চার্চের নাম হয় ক্যাথলিক চার্চ। পোপ শব্দটি গ্রিক papa (পিতা) শব্দ থেকে এসেছিলো। পোপের অধীনে পুরো খ্রিস্টধর্মজগৎকে পরিচালনা করার সাংগঠনিক কাঠামো হলো পোপতন্ত্র। অন্যান্য প্যাট্রিয়ার্কেটগুলোকে ছাপিয়ে রোমের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের একটি ধর্মীয় কারণ ছিলো স্বয়ং যিসাসের কাছ থেকে চলে আসা কথিত ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের ধারা। যিসাসের শিষ্য সেইন্ট সাইমন পিটারকে ধরা হয় প্রথম পোপ। তাঁর মেয়াদকাল ধরা হয় ৩৩ সাল থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যিসাসের কথিত ক্রশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পরেই তিনি খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সেইন্ট পিটার ছিলেন রোমের বিশপ। তাই পিটারিয়ান মতবাদ (Petrine doctrine) অনুসারে রোমের বিশপই উত্তরাধিকারসূত্রে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতৃত্বে অধিকারী।

ক্যাথলিকরা দাবি করেন, যিসাস সেইন্ট পিটারকে খ্রিস্টধর্মজগতের অধ্যাত্মিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকার প্রদান করে যান, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে চার্চ সংগঠন। যিসাস কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী হিসেবে একের পর এক পোপ এসে খ্রিস্টধর্মজগতের অধিপতির আসনে বসবেন। এ  মতবাদকে বলা হয় পিটারিয়ান মতবাদ। অনেক খ্রিস্টানই এ মতবাদ মানতে চাননি। তাদের মতে, খ্রিস্টধর্মজগতের ওপর একক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যিসাস প্রদত্ত নয়; এটা পরবর্তী সময়কালীন রোমান চার্চের অধিপতিদের আবিষ্কার। এ বক্তব্যের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি হলো, বাইবেলের কোথাও পোপ বা পোপতন্ত্রের কোনো উল্লেখ নেই এবং সেইন্ট পিটারকেও শীর্ষ ধর্মীয় প্রতিনিধিত্ব প্রদানের কোনো কথাও বাইবেলে নেই। পোপ বা রোমান চার্চকে খ্রিস্টধর্মজগতের অধিকর্তা হিসেবে মেনে নিতে গোড়া থেকেই অনেকে বিরোধীতা করেন।

বিশেষ করে কনস্টানটিনোপলের চার্চকে অতিক্রম করে রোমান চার্চকে নেতৃত্বে আসতে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়েছিল। এর কারণ রোম নগরীকে নিয়ে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য যখন ভেঙ্গে পড়েছে তখন পূর্বের কনস্টানটিনোপলকে এই ভাঙ্গন স্পর্শ করে নি। এ কারণে কনস্টানটিনোপলের চার্চও ছিলো যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু রোমান চার্চের নেতৃত্বে পশ্চিম  ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটায় এবং রোমের সাথে খ্রিস্টধর্মের উজ্জ্বল ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার জড়িত থাকায় একসময় রোমান চার্চই শীর্ষস্থানীয় ভূমিকায় চলে আসে। খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের শক্তিশালী কেন্দ্র ছিলো রোম। রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণকারী জার্মানদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছিলেন রোমান চার্চের যাজকরাই। দুধর্ষ বর্বরদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে রোমান চার্চের যাজকরাই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এছাড়াও পরবর্তীতে রোমান পোপের মধ্যস্থতায় রোম নগরী একাধিকবার বর্বর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষাও পেয়েছিল। আক্রমণকারী ও দখলদার জার্মানদের হাত করতে পারাই ছিলো রোমান চার্চের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

141

চিত্র: ভিসিগথ যোদ্ধা

এ সাফল্য রোমান চার্চকে এক অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায় যা ইতিহাসে ছিলো অভূতপূর্ব! কনস্টানটাইনের পর থেকে জার্মান বর্বরদের আক্রমণে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য যতোই দুর্বল হয়ে পড়ছিল পশ্চিম ইউরোপে ততই বাড়ছিলো রোমান চার্চের প্রভাব! তাই ধর্মীয় ক্ষেত্রে রোমান চার্চের আধিপত্য অন্য সবার চেয়ে বেড়ে গিয়েছিল। রোমান চার্চের এ আধিপত্য মেনে নিতে চায় নি কনস্টানটিনোপলের চার্চ। সম্রাট কনস্টানটাইনের পরবর্তী দু’তিনজন সম্রাটের শাসনের পর সম্রাট ১ম থিওডোসিয়াসের (৩৭৯-৩৯৫ খ্রি.) সময়ে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম আরও গুরুত্ব লাভ করে। সম্রাট থিওডোসিয়াস ৩৮০ সালে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেন। তাঁর সময়ে কনস্টানটিনোপলকে খ্রিস্টধর্মজগতের নেতৃত্বে আনার একটি প্রচেষ্টা হয়েছিল। সে সময় কনস্টানটিনোপল ছিলো অখন্ড রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। রাজধানীতে ৩৮১ সালে খ্রিস্টধর্মীদের ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। সে সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কনস্টানটিনোপলের বিশপের মর্যাদা রোমের বিশপের ওপরেই নির্ধারিত হবে। এ সম্মেলন থেকে কনস্টানটিনোপলকে ‘নোভা রোমা’ বা নতুন রোম হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

কিন্তু তখনকার রোমান পোপ প্রথম ড্যামাসাস (৩৬৬-৮৪ খ্রি.) এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেন নি। তাঁর মতে যিসাস কর্তৃক পিটারকে দেওয়া নেতৃত্বের উত্তরাধিকার একমাত্র রোমান চার্চেরই; কোনো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত দ্বারা এ নিয়ম বদলানো সম্ভব নয়। তাই তিনি সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে আগ্রাহ্য করেন। তাঁর পরবর্তী পোপরাও এ মতবাদে অটল থাকেন। কিন্তু রোমান পোপরা খ্রিস্টধর্মজগতের ওপর নিরংকুশ একক নেতৃত্ব কখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। শুধু কনস্টানটিনোপল নয়, আলেকজান্দ্রিয়া, এন্টিয়ক ও জেরুজালেমের বিশপরাও রোমান পোপকে অনেক সময় মানতে চান নি। তবে রোমান চার্চ অধিকাংশ সময়ই নিরংকুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও পশ্চিম ইউরোপে এর প্রভাব বিস্তারে কোনো সমস্যা হয় নি। রোমান চার্চের আওতাধীন পশ্চিম ইউরোপে পোপের প্রভাব ছিলো নিরংকুশ। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকেও ইউরোপে রোমান চার্চের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে।

৩৯৫ সালে সম্রাট থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম এ দুই অংশে ভাগ হয়েছিল। এর মধ্যে পূর্ব রোম সাম্রাজ্য বর্বর আক্রমণের হাত থেকে অনেক নিরাপদ ছিলো। কিন্তু ৪০০ সাল থেকে বর্বর আক্রমণের ধাক্কায় পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। আর সেই সাথে অদ্ভূতভাবে বাড়তে শুরু করে রোমান চার্চের গুরুত্ব! ৪০১ সালে জার্মান গোত্র স্যাক্সনরা রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত ব্রিটেনে আক্রমণ চালায়। সেখানকার রোমানরা পরাজিত হয়ে রোমে ফিরে আসে। ৩৭৯ সালে ক্ষমতায় বসে সম্রাট থিওডোসিয়াস জার্মান গোত্র ভিসিগথদের সাথে মৈত্রী-চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অদক্ষ পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ৪১০ সালে ভিসিগথ নেতা এলারিক রোম নগরী দখল ও লুন্ঠন করেন।

এর পরবর্তীতে আসেন দুধর্ষ তাতার গোত্র হুনদের নিয়ে তাদের নেতা এটিলা। তখন ৪৫২ সাল। হুনদের আক্রমণ থেকে রোম নগরীকে বাঁচাবার মতো কেউ ছিলো না। তখন পোপ ১ম লিও এক অসমসাহসী কান্ড করে রোম নগরীকে বাঁচিয়ে দেন। পোপ আর তাঁর সঙ্গীরা জীবন উৎসর্গ করার জন্য সাদা পোশাকে নেমে আসেন যুদ্ধের মাঠে। এটিলা এইসব সাদা পোশাকধারী নিরস্ত্র ধার্মিক লোকদের হত্যা করতে উৎসাহ বোধ করলেন না। তাই রোমে প্রবেশ না করে তিনি ফিরে চলে যান অজানা দেশের উদ্দেশ্যে।

142

চিত্র: শিল্পীর তুলিতে এটিলা

পোপ লিওর এই সাহসী ভূমিকা রোমান চার্চের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। পোপ লিওর সময়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, পোপকে অস্বীকার করা মানে সেইন্ট পিটারকে অস্বীকার করা আর সেইন্ট পিটারকে অস্বীকার করা মানে খোদ যিসাসকেই অস্বীকার করা। পোপ লিওর মতো পরবর্তী সময়ে রোমান চার্চের মধ্যস্থতায় লম্বার্ডরাও রোম আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছিলো। এসব কারণে ৪৭৬ সালে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ও বর্বর শাসনের সূচনার পরও রোমান চার্চের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিলো।

রোমের এসব রাজনৈতিক বিপর্যয়ে চার্চের কোনো ক্ষতি হলো না। বরং রাষ্ট্রক্ষমতার পতনের ফলে চার্চের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেলো। জার্মান বর্বরদের হাতে রোমের পতন হলেও খ্রিস্টধর্মের পতন হয় নি। বর্বররা খ্রিস্টধর্মকে নিজেদের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং তারাই এ ধর্মকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছিল। এটা পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাজার বছরের পুরনো রোমান শাসনের পতনের পর মানুষ পোপের ধর্মীয় নেতৃত্বকেই শেষ ভরসা মনে করে। রোমানরা রাষ্ট্র হারিয়ে পোপকেই তাদের শেষ আশার স্থল হিসেবে দেখতে শুরু করে। অন্যদিকে বর্বর গোত্রগুলো খুব দ্রুত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। ফলে চার্চের ক্ষমতা অক্ষুন্ন থকে।

রাষ্টব্যবস্থার পতনের ফলে চার্চই ধর্মীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এভাবে পোপতন্ত্র একটি শক্তিশালী অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। পোপতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যার ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন পোপ প্রথম গ্রেগরি। ৫৯০ সাল থেকে ৬০৪ সাল পর্যন্ত তিনি পোপের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেইন্ট পল ও কনস্টানটাইনের মতোই খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে এই পোপের ভূমিকাটিও অনন্য।

খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের গতিপথকে প্রভবিত করার ক্ষেত্রে হাতেগোনা যে কয়জন ব্যক্তি মৌলিক ভূমিকা পালন করেছেন তার মধ্যে এই পোপ প্রথম গ্রেগরি অন্যতম। খ্রিস্টধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে সদ্য বিলুপ্ত পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে চলছিলো জার্মান জাতিগুলোর বিচ্ছিন্ন শাসন। এসব অঞ্চলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তাই দূরদর্শী পোপ প্রথম গ্রেগরি এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রব্যস্থার অভাবকে কাজে লাগাতে চাইলেন।

৪৭৬ সালে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির বহু আগ থেকেই সে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব হারাতে শুরু করেছিল রাজধানী রোম। সম্রাটরা বর্বরদের হাতে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন থেকে বিভিন্ন বর্বর গোষ্ঠীর অধীনে বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন শাসন শুরু হয়। রোমান শাসনের সমাপ্তির পরও এ ভাঙন অব্যাহত থাকে। কোনো বর্বর সম্রাটই সমস্ত অঞ্চলকে অভিন্ন শাসনের আওতায় নিয়ে আসতে পারেননি।

143

চিত্র : শিল্পীর তুলিতে পোপ প্রথম গ্রেগরি

বর্বর শাসিত পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। মুদ্রা, অর্থনীতি, সরকার, প্রশাসন, আইন-আদালত, শিক্ষা ও লিখিত ভাষা – এসব ব্যাপারে বর্বরদের কোনো ধারণা ছিলো না। তাই তারা কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলতে পারে নি। এই পরিস্থিতিতে চার্চের হাতে প্রশাসনিক কাজের ভার চলে আসতে শুরু করেছিল। তাই পোপ প্রথম গ্রেগরি চার্চ সংগঠনকে রাষ্ট্রের বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিলেন। পশ্চিম ইউরোপজুড়ে অভিন্ন ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থার অভাব চার্চ ও পোপের গুরুত্বকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ সুযোগে পোপ বর্বর রাজ্যগুলোতে রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে ধর্মীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিলেন। এমনকি অনেকগুলো আলাদা রাজ্যকে এক অভিন্ন ধর্মীয় রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসারও স্বপ্ন দেখলেন পোপ।

পোপ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দেশগুলোর ধর্মীয় সংহতিকে মজবুত করে এক অভিন্ন ধর্মীয় শাসনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিস্টান কমনওয়েলথ (society of Christian Commonwealth)। ব্রিটেন, গলসহ বিভিন্ন দেশের চার্চ সংগঠন এই কমনওয়েলথ এর সদস্য ছিলো। এভাবে সাবেক রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান সমাজের ওপর পোপের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হয়। পোপ গ্রেগরি বুঝতে পেরেছিলেন রোমান চার্চের কর্তৃত্ব পাশ্ববর্তী বাইজেনটাইন সম্রাট পছন্দ করবেন না। তাই তিনি খ্রিস্টান কমনওয়েলথকে শক্তিশালীকরণ এবং রোমান চার্চ ও পোপের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পোপ এমন সব অঞ্চল বেছে নিলেন যেখানে বাইজেনটাইন সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ নেই।

পোপ গ্রেগরির পূর্ববর্তী পোপগণ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে রোমান চার্চের অধিপত্য বিস্তারকেই একমাত্র করণীয় মনে করতেন। কিন্তু পোপ গ্রেগরি এটাকেই একমাত্র উদ্দেশ্য মনে করতেন না। বাইজেন্টাইন সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণকেও তিনি কর্তব্য মনে করতেন না। তাই বাইজেন্টাইন কর্তৃত্বের বাইরের অঞ্চলেই তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নিলেন। পোপ উত্তর ও মধ্য ইউরোপজুড়ে ধর্ম প্রচারকদের পাঠাতে শুরু করেন। ব্রিটেন ও গলে এসব ধর্মপ্রচারকরা বিশেষভাবে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। রোমান চার্চ ও পোপের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বহু মানুষকে খ্রিস্টধর্মে নবদীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ধর্ম প্রচারকরা। ইতালিতে পোপ গ্রেগরির প্রচেষ্টায় লম্বার্ডরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। স্পেনের ভিসিগথদের মধ্যেও রোমান চার্চের নিরংকুশ প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়।

পোপ গ্রেগরির অন্যতম উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিলো ব্রিটেনে খ্রিস্টধর্মের প্রসার। একসময় রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ব্রিটেনে খ্রিস্টধর্মের কিছুটা প্রসার হয়েছিল। কিন্তু ৪০১ সালে সম্রাট হনোরিয়াস গলদের হাত থেকে ইতালি রক্ষার জন্য ব্রিটেনে নিয়োজিত রোমান বাহিনীকে তলব করলে ব্রিটেন হতে চিরতরে রোমান বাহিনীকে প্রত্যাহার করা হয় এবং রোমান শাসন ও খ্রিস্টধর্মের প্রচার দুটোরই সমাপ্তি ঘটে। একসময় ব্রিটেন চলে যায় তিনটি অখ্রিস্টান নিম্ন জার্মান গোষ্ঠী Angles, Saxons ও Jutes- দের দখলে। ফলে ব্রিটেন থেকে খ্রিস্টধর্ম প্রায় হারিয়ে যেতে শুরু করে। এমতাবস্থায় পোপ গ্রেগরি ব্রিটেনে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য সেইন্ট অগাস্টিন (St. Augustine)- এর নেতৃত্বে ৪০ জন সন্ন্যাসীকে পাঠালেন।

কথিত আছে, একদিন পোপ গ্রেগরি রোমের দাসের হাটে একদল বিদেশী ক্রীতদাস বালক দেখতে পান। এই বালকদের বিষয়ে তিনি জানতে চাইলে তাকে জানানো হলো এরা ব্রিটেনের Angles গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। তখন পোপ বলে ওঠেন ‘not Angles but angels’। শোনা যায়, তখনই পোপ সংকল্প করেন যে তিনি ব্রিটেনের অ্যাংলো-স্যাক্সনদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করবেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ৫৯৬ সালে অগাস্টিনের দলকে ব্রিটেনের কেন্ট প্রদেশের উদ্দেশ্যে পাঠান। ৫৯৭ সালে অগাস্টিনের দল কেন্টে পৌছায়।

144.jpg

চিত্র : শিল্পীর তুলিতে সেইন্ট অগাস্টিন

সৌভাগ্যক্রমে তখন কেন্টের রাজা ইথালবার্ট (Ethelbert)- এর রানী ছিলেন একজন ধার্মিক খ্রিস্টান। আত্মত্যাগী সন্নাসীদেরকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। রানী এবং সন্ন্যাসীদের প্রভাবে রাজা ইথালবার্টও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং কেন্টিশ (Kentish) লোকজনের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যান্টারবারি (Canterbury)-তে একটি চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অগাস্টিন সে চার্চের প্রথম আর্চবিশপ নির্বাচিত হন। এভাবে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে খ্রিস্টধর্মের যাত্রা শুরু হয়।

ব্রিটেনের মতো অন্যান্য স্থানেও পোপ গ্রেগরির উদ্যোগ সফল হয় এবং বাইজেন্টাইন সম্রাটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে পোপের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ নিরংকুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিম ইউরোপে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী পোপতন্ত্র (Papacy)। এভাবে রোমান চার্চের আধিপত্য ও প্রাতিষ্ঠানিতা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ধর্মীয় কর্তৃত্বের গন্ডী পেরিয়ে চার্চ জাগতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়ও অনেকদূর এগিয়ে যায়। বর্বরদের হাতে রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর হতেই বর্বর শাসকরা খ্রিস্টধর্মের যাজকদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তোলে দিতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসনে যাজকশ্রেণির অংশগ্রহণের এই ধারাকে পোপ গ্রেগরি সর্বোচ্চ মাত্রায় অধিষ্ঠিত করলেন।

পোপ সম্রাটের কাছ থেকে রোমের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব লাভ করে চার্চের কর্তৃত্বের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, একসময় সম্রাটের প্রতিভূ হিসেবে মুদ্রা জারি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত পরিচালনার দায়িত্বও পোপের হাতে চলে আসে। পোপ গ্রেগরি চার্চের পার্থিব ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অধিষ্ঠিত করলেও তিনি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় অটল ছিলেন। মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তির পাশাপাশি জাগতিক মুক্তিও নিশ্চিত করার স্বপ্ন থেকে তিনি রোমান চার্চের আওতাধীন এলাকাজুড়ে পার্থিব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা কোনোভাবেই দূরভিসন্ধিমূলক ছিলো না।

পোপ গ্রেগরি সৎ উদ্দেশ্যে রোমান চার্চের অধিপত্য বিস্তারকে জরুরি মনে করলেও পরবর্তীতে অনেক পোপ ও ধর্মযাজকরা সৎ থাকতে পারেন নি। চার্চ ও খ্রিস্টধর্মকে আত্মস্বার্থে ব্যবহারের সে ইতিহাসও অনেক দীর্ঘ; চার্চ পরিণত হয়েছিল ধর্মব্যবসায়ীদের আঁখড়ায়। চার্চের ক্ষমতাকে অনেক পোপ নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করেছেন এবং আধ্যাত্মিক নৈতিকতা জলাঞ্জলী দিয়ে রাজনৈতিক শক্তি করায়ত্ত করার প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত হয়েছিলেন।

তাই খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠানিক শক্তি অনেক ক্ষেত্রে খিস্টধর্মকে ভূল পথে পরিচালিত করেছে। পোপতন্ত্র যেভাবে প্রথমদিকে ভেঙ্গে পড়া পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের মানুষকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলো সেপথে পরবর্তীতে তা আর থাকেনি। অনেক রোমান পোপের নিন্দনীয় ভূমিকার জন্য পোপতন্ত্র দায়ী হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। সেসব আরেক ইতিহাস! পোপ গ্রেগরি কর্তৃক ব্রিটেনে ধর্মপ্রচারকদের দল প্রেরণের ৬ বছর পর অর্থাৎ ৬০২ সালে শুরু হয় পারস্য – বাইজেন্টাইন যুদ্ধ। আরও ৮ বছর পর অর্থাৎ ৬১০ সালে  বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন সম্রাট হেরাক্লিয়াস।

পোপ গ্রেগরি অবশ্য এর আগেই ৬০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একপ্রকার সমাপ্তিই ঘটে যায় খ্রিস্টধর্মের অগ্রযাত্রার। যেসব শূন্যতা ও সমস্যা গোড়া থেকেই খ্রিস্টধর্মের সঙ্গী হয়ে এসেছিলো তা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে খ্রিস্টধর্মকে। ইহুদি ধর্মের মতোই এক আচারস্বর্বস্ব ধর্মে পরিণত হয় খ্রিস্টধর্ম। পোপ গ্রেগরির পরবর্তী সময়ে তাঁর রেখে যাওয়া জাগতিক ক্ষমতা ও সুবিধাসমূহ চার্চের যাজকশ্রেণিকে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে পরিণত করে। জাগতিক ক্ষেত্রে চার্চের ক্ষমতা ধর্মীয় সুবিধাবাদের জন্ম দেয়। তাই ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে দেখা যায় অনেক নিবেদিত প্রাণ খ্রিস্টর্ধর্মী রোমান চার্চকে খ্রিস্টধর্মের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হন নি। পোপতন্ত্রের উদ্ভবের ফলে রোমান চার্চ খ্রিস্টধর্মের নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসলেও তা একেবারে নিরংকুশ ছিলো না।

ইসলামের উত্থানের পর খ্রিস্টধর্মের পাঁচটি প্যাট্রিয়ার্কেটের তিনটিই হারিয়ে যায়। এগুলো হলো এন্টিয়ক, জেরুজালেম ও আলেকজান্দ্রিয়া। এ তিনটি প্যাট্রিয়ার্কেটের অধিকাংশ খ্রিস্টধর্মী ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যায়। বাকি রইল শুধু দুটি কেন্দ্র। রোম ও কনস্টানটিনোপল। কনস্টানটিনোপলের চার্চের প্যাট্রিয়ার্ক রোমান পোপের অধিপত্য মেনে নেন নি। ফলে এ দুটি চার্চের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। এ দ্বদ্বের রেশ ধরেই ১২০৪ সালে রোমান চার্চের নেতৃত্বাধীন ক্রসেডাররা কনস্টানটিনোপল দখল ও ধ্বংশ করে। রোমান চার্চ পরিচিতি পেয়েছিল ক্যাথলিক চার্চ নামে। পশ্চিম ইউরোপ ছিলো এর অন্তর্ভুক্ত। আর কনস্টানটিনোপলের চার্চ পরিচিতি পায় অর্থডক্স চার্চ নামে। পূর্ব ইউরোপ ছিলো এর অন্তর্ভুক্ত। একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ দুই চার্চের বিরোধ অনেক প্রাণহানী ও রক্তপাতের কারণ হয়েছে।

145.jpg

চিত্র: যিসাসকে নিয়ে আলেকজান্ডার পোপের কবিতা

১৪৫৩ সালে মুসলমানদের হাতে কনস্টানটিনোপলের পতন ঘটলে একসময়ের পাঁচটি প্যাট্রিয়ার্কেটের মধ্যে শুধুমাত্র রোমই টিকে থাকে। অবশ্য রাশিয়া ও বলকান অঞ্চলে অর্থডক্স চার্চের প্রভাব থেকে গিয়েছিল যা আজও বিদ্যমান। অন্যদিকে কনস্টানটিনোপলের পতনের পর পুরো মধ্যযুগ জুড়ে পশ্চিম ইউরোপে দাপটের সাথে টিকে থাকা পোপতন্ত্র ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের অধিপত্যেও ভাঙ্গন শুরু হয়। কনস্টানটিনোপলের পতন সঙ্গে করে নিয়ে আসে নতুন একটি যুগ- আধুনিক যুগ এবং জন্ম দেয় রেনেসাঁর। রেনেসাঁ সঙ্গে করে নিয়ে আসে নতুন চিন্তা-চেতনা ও উপলদ্ধি এবং জন্ম দেয় রিফর্মেশন আন্দোলনের।

রিফর্মেশন মানে হলো খ্রিস্টধর্মের সংস্কার আন্দোলন, যা দাবি করে খ্রিস্টধর্মে পোপতন্ত্রের কোনো স্থান নেই এবং পোপ বা ক্যাথলিক চার্চের প্রতি আনুগত্যের কোনো বাইবেলীয় (Biblical) ভিত্তি নেই। খ্রিস্টধর্মের নতুন ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম ইউরোপে রোমান চার্চের প্রভাবমুক্ত আলাদা চার্চের যাত্রা শুরু হয়। রিফর্মেশন আন্দোলন প্রথম শুরু হয় জার্মানিতে যা Protestant Reformation বা Protestantism নামে বিখ্যাত। Protestant Reformation বা Protestantism এর সম্প্রসারণ হলো English Reformation বা Anglicanism যা ইংল্যান্ডকে পোপের প্রভাব থেকে আলাদা করে; স্থাপিত হয় English National Church. Anglicanism এর পরবর্তী ধাপ হলো Puritanism যা ইংল্যান্ড হতে পোপ ও ক্যাথলিক চার্চের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার উগ্র বাসনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। এভাবে একসময়কার ক্যাথলিক সাম্রাজ্য হারিয়ে যেতে থাকে। বিভিন্ন দেশ ক্যাথলিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন চার্চ প্রতিষ্ঠা করে। একসময় জাতিরাষ্ট্রের উত্থান চূড়ান্ত আকার ধারণ করলে পোপতন্ত্রী ক্যাথলিক সাম্রাজ্য বিলীন হয়ে যায়।

— — —

(লেখক: আসিফ আযহার | শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় | 01785 066 880)

Leave a comment